মেহগনি গাছের ছাল-বাকল আর ফল দিয়ে তৈরি হচ্ছে কৃষিতে ব্যবহারের বালাইনাশক। সেটি ব্যবহারে সফলও হয়েছেন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার শতাধিক কৃষক। কৃষকদের দাবি, রাসায়নিকের পরিবর্তে কৃষিতে জৈব ওই বালাইনাশক কর্ম কার্যকর নয়।
জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে- কয়েকজন কৃষক তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মেহগনি ফল, বাকল ও পাতা দিয়ে জৈব বালাইনাশক তৈরিতে ব্যস্ত। ফল থেকে খোসা ছড়িয়ে এবং ছাল-বাকল ও গাছের পাতাসহ একত্রে চুর্ণ করছিলেন তারা।
এ সময় ওই গ্রামের কৃষক নাজমুল খান (২৫) বলেন, গতবছর সবজি চাষে মেহগনির ফল, পাতা আর ছাল বাকলের তৈরি বালাইনাশক ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছি। এবার আমন ধানের আবাদেও ব্যবহার করছি।
তিনি বলেন, জৈব ওই বালাইনাশক ব্যবহারে খরচ যেমন কমেছে, খাদ্যের গুনগত মানও ভালো থাকছে।
একই গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান (৫৫) বলেন, গত জানুয়ারি মাসে ওই বালাইনাশক ব্যবহার করে করলা, ঝিঙ্গা, চিচিংগা, চালকুমড়া, শসা, তরমুজ, সিম, লাউ আবাদ করে ভালো ফল পেয়েছি। স্থানীয় বাজারে এসব সবজির চাহিদাও প্রচুর। এমন সফলতায় ওই বালাইনাশক তৈরি করে এবার চার বিঘা জমিতে আমন ধান ক্ষেতে ব্যবহার করছি। ধান বের হওয়া পর্যন্ত চার বার ব্যবহার করায় কোনো পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি।
তিনি বলেন, বাজার থেকে বালাইনাশক কিনে এ পরিমাণ ক্ষেতে চার বার ব্যবহারে খরচ হতো অন্তত ৫ হাজার টাকা। সেখানে আমার সামান্য শ্রমে ওই পরিমাণ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।
অপর কৃষক আতাউর রহমান (৫০) বলেন, আমি এবছর চার বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করেছি। ওই চার বিঘার মধ্যে দেড় বিঘায় আমি বাড়িতে তৈরি করা জৈব বালাইনাশক ছিটাচ্ছি, বাকি আড়াই বিঘা জমিতে বাজার থেকে কেনা রাসায়নিক বালাইনাশক ছিটাচ্ছি। কিন্তু বাড়ির তৈরি বালাইনশাকের ফলাফল ভালো পচ্ছি।
জৈব ওই বালাইনাশকের উদ্ভাবক জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায়। তিনি বলেন, দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হলেও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। আগে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা ছিল মূল লক্ষ্য। ওই স্বয়ংসর্ম্পূতা অর্জনের পর এখন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই।
জৈব ওই বালাইনাশক উদ্ভাবনের বিষয়ে বলেন, দেশকে সেবা দানের লক্ষ্যে দুই বছর যাবৎ নিরাপদ সবজি উৎপাদনের বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে গবেষণা শুরু করি। বিভিন্ন জার্নাল, বই, ওয়েবসাইট অনুসন্ধান করে মেহগনির ফল, বাকল ও পাতার ভেষজ গুণকে কাজে লাগিয়ে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের কথা অবগত হয়ে এ বছরের জানুয়ারি মাসে গোটা উপজেলার ২০০ জন কৃষকের সবজি প্লটে ওই জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে ভালো ফল পাই। এবার কালিকাপুর গ্রামে চারজন কৃষকের আমনক্ষেতে পরীক্ষামূলক ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। এতে করে এলাকার অনেক কৃষক আগ্রহী হয়েছেন। আগামীতে এর বহুগুণ ব্যবহার বাড়ার আশা করছি।
জৈব ওই বালাইনাশকের প্রস্তুতের বিষয়ে তিনি বলেন, মেহগনির ফল, বাকল ও পাতার নির্জাস দিয়ে দুইভাবে প্রস্তুত করা যায়।
প্রথমত চার কেজি মেহগনির ফল, এক কেজি পরিমান গাছের বাকল ও পাতা ভালোভাবে গুড়া করে নিতে হবে। তারপর দুই লিটার পানিতে ওই গুড়া ঢেলে দিতে হবে। তাতে কয়েকটি রসুন কোয়ার গুড়াসহ মিশ্রিণ করে পাঁচ থেকে সাত দিন রেখে দিতে হবে। এরপর মিশ্রণটিকে ছাকনি দিয়ে ছেঁকে নিয়ে চারগুণ পানি এবং ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট গুড়া মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, তিন থেকে চার কেজি মেহগনির ফল হতে প্রাপ্ত বীজ, গাছের বাকল ও পাতা পাঁচ লিটার পানিতে মিশিয়ে তাতে ১০ গ্রাম তুতিয়া, ৫ গ্রাম সোহাগা ও কয়েকটি রসুন কোয়ার গুড়া মিশ্রণ করে আধা ঘণ্টা উচ্চ তাপে ফুটিয়ে নিতে হবে। এমনভাবে ফুটাতে হবে যাতে ৫ লিটার মিশ্রণ কমে গিয়ে অর্ধেকে পরিণত হয়। এরপর মিশ্রণটি ঠান্ডা করে নিতে হবে। এবার ছেঁকে নিয়ে ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট গুড়া মিশিয়ে পাঁচগুণ পরিমাণ পানি মিশিয়ে দুই থেকে তিন দিন পর ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
তিনি জানান, ধানক্ষেতে সাত দিন পর পর তিন বার প্রয়োগ করলে ধানের মাজরা, পাতা মোড়া, শীষ কাটা লেদা পোকা দমন করা সম্ভব। এছাড়াও ফুলকপি, বাঁধাকপির লেদা পোকা, ভুট্টার লেদা পোকা, টমেটো, শিম ও বরবটির লেদা পোকা, উইপোকা, পিঁপড়া, মশা দমন করা সম্ভব। এই বালাইনাশক যে জমিতে ছিটানো হয়, সে জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব কম হয়। বিভিন্ন গুদামজাত শস্যের বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও এটি বেশ কার্যকর। বালাইনাশক প্রস্তুতের উচ্ছিষ্ট অংশ জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। উক্ত সার মাটিতে প্রয়োগ করলে একদিকে যেমন মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে অন্যদিকে বিভিন্ন মাটিবাহিত রোগ ও পোঁকার আক্রমণ কম হয়।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, এটা আসলে গবেষণার ফল নয়। পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায় এটা উদ্ভাবন করেছেন। তাতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।