ঢাকার জীবন কত কঠিন

 

করোনার লকডাউন শুরুর পর থেকেই অনেকে লোটাকম্বল নিয়ে চুকিয়ে ফেলেন ঢাকার পাঠ। এর মধ্যে সম্প্রতি আবার যে গতিতে চাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে, তাতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা আর পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকার স্বপ্ন দেখছেন না। রোজার ঈদে পরিবার নিয়ে গ্রামে গেলেও দেখা গেছে শুধু চাকরি বা ব্যবসা যিনি করতেন, তিনিই ফিরে এসেছেন। বাকিরা থেকে গেছে গ্রামে। ফ্ল্যাট ছেড়ে অনেকে উঠেছেন মেসে। এমন একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ তথ্য।

গত দুই বছর রাজধানী ছেড়ে কত লোক গ্রামে গেছে তা নিয়ে জরিপ হয়নি। তবে নিম্ন আয়ের লোকজন যে এলাকাগুলোতে থাকতেন- বিশেষ করে বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মাদারটেক, শনিরআখড়া, কামরাঙ্গিরচর, রামপুরা, নন্দীপাড়া, মাতুয়াইল, ঘাটারচর- এসব এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক ভাড়াটিয়াই বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। যারা আছেন তারা কয়েকজন মিলে মেস করে আছেন। অনেকে আছেন সাবলেটে। বেশিরভাগ বাড়িতেই দেখা গেছে ‘টু-লেট’। আর তাই এখন সাবলেট, মেস বা ব্যাচেলর নিয়েও ভাবছেন না বাড়িওয়ালারা।

ঢাকাঢাকাখোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, স্কুলের বেতনসহ আনুষাঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় মধ্যম আয়ের মানুষরা পরিবার নিয়ে রাজধানীতে থাকতে পারছেন না। আগে নিম্নবিত্তদের অঞ্চলগুলোয় টিনশেড বাড়ির এক রুম ভাড়া পাওয়া যেতো হাজার থেকে পনের শ’ টাকায়। সেই সব টিনশেড হয়ে গেছে বহুতল ভবন। বাড়িগুলো হয়ে গেছে অ্যাপার্টমেন্ট। ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ। আলাদা এক রুম ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে রাজধানী ছেড়েছে হাজারো নিম্নব্ত্তি পরিবার।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক সময় যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের বাস ভাড়া ছিল ২ টাকা। সেটা হয়েছে ২০ টাকা। মিরপুর থেকে মতিঝিলের ভাড়া ছিল ৫ টাকা। এখন গুনতে হয় ৪০ টাকা। ৪০ টাকার রিকশাভাড়া হয়েছে ৮০ টাকা। যেনতেন স্কুলের বেতনও হাজার-দেড় হাজারের নিচে নয়। ৩০ টাকা কেজির চাল একলাফে ৬০ টাকা, ৮০ টাকার সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা, ৭০ টাকা কেজি দরের পাঙ্গাস মাছ ২২০ টাকা, ২২ টাকা হালির ফার্মের মুরগির ডিম ৩৮ টাকা এবং ৩০ টাকার ময়লার বিল হয়েছে ১০০ টাকা (এলাকাভেদে আরও বেশি)। বাদ যায়নি সিটি করপোরেশন পরিচালিত পাবলিক টয়লেটের খরচও। ২ টাকা থেকে হয়েছে ৫ টাকা। জীবনযাত্রার ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সেই হারে বাড়েনি আয়।

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুসলিম নগরের সবজি বিক্রেতা বরকত মিয়া জানান, ‘এক সময় এই এলাকায় দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় টিনশেড বাড়িতে এক রুম ভাড়া পাওয়া যেত। এখন টিনশেডই নাই। ছোট একটা ফ্লাটের ভাড়া দশ হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে এত টাকা দিয়ে থাকবো কোন দুঃখে! তাই পরিবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। নিজে মেসে থাকি। ৯ হাজার টাকা ভাড়ার ফ্লাটে ৯ জন থাকি।’

নন্দীপাড়ার বাড়িওয়ালা নুরুল ইসলাম লিটন জানিয়েছেন, ‘পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া টিনশেড বাড়ির পাঁচ রুম ভাড়া দিয়ে পেতাম ১০ হাজার টাকা। এ থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল আমাকেই দিতে হতো। ভ্যানওয়ালা, রিকশায়ালা, অটোওয়ালারা পরিবার নিয়ে থাকতো। এখন তারা পরিবার বাড়িতে রেখে এসেছে। মেস করে থাকতে চায়। এখন পাঁচটা রুম ভেঙে কারখানা ভাড়া দিয়েছি। ভাড়া পাই ২০ হাজার টাকা।’

ঢাকা ছাড়ার হিড়িকঢাকা ছাড়ার হিড়িকবেসরকারি ব্যাংকের মাঝামাঝি পর্যায়ের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ৮ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতেন মাদারটেক এলাকায়। সেই ভাড়া এখন ১২ হাজার টাকা। দুই সন্তানের স্কুলের ফি ছিল ১২ শ’ টাকা। সেটা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। ঘরের কাজের জন্য একজন কর্মী ছিল। তার বেতন আট শ’ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে দেড় হাজার টাকা। আগে অফিসে আসতেন ৩০ টাকা রিকশাভাড়ায়। এখন সেটাও দেড় শ’ টাকা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে খরচ বাড়তে থাকায় তিনি পরিবারের বাকি সদস্যদের বাড়িতে রেখে নিজে একা থাকছেন ঢাকায়। ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠেছেন মেসে।

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বেতন তো বাড়েনি। তাই সবাইকে রেখে এসেছি। এখন মাস শেষে বেতন পেয়ে ২০ হাজার টাকা পাঠাই। তা দিয়ে ভালোই চলছে। ঘরভাড়া, গৃহকর্মীর বেতন লাগছে না। গ্রামের স্কুলে বেতনও কম। বাকি টাকায় নিজে চলছি ও সঞ্চয় করছি।’

এদিকে বিভিন্ন কারণেই ঢাকা হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা। কিছুদিন আগে বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের নতুন র‌্যাংক প্রকাশ করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। তাতে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭ নম্বরে।

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তামজিদ নাহিদ জানিয়েছেন, ‘জীবনমান বজায় রেখে রাজধানীতে বাস করা কঠিন। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে আবার নতুন মাত্রা দিয়েছে করোনা। মহামারির কারণে বহু মানুষ কর্মহীন। পেশা ও স্থান বদলে বাধ্য হয়েছেন বিশাল এক শ্রেণি। বলা যায়, অনেকটা নীরবে একটা বড় মাইগ্রেশন হয়েছে।’

ঢাকায় বায়ুদূষণঢাকায় বায়ুদূষণএ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ জানিয়েছেন, ‘সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় গ্রামে সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামের গরিবরা সেই অর্থে আর গরিব নেই। তারা শহরে আসতে চান না। নিজের বাড়িতে বসেই নগদ সহায়তা পাচ্ছেন। ঠিকানাবিহীন মানুষেরা পাচ্ছেন সেমিপাকা ঘর। এরপর্র কে আসবে ঢাকার বস্তিতে থাকতে? গ্রামের শিক্ষার্থীরাও এখন স্কুল থেকে শিক্ষা উপকরণসহ বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। পাচ্ছে এক বেলা খাবারও। এতো সুযোগ-সুবিধা রেখে নিম্নবিত্তরা রাজধানীতে থাকবে কেন?’


SHARE THIS
Previous Post
Next Post